রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ ও নির্বাচন ব্যবস্থা সরলীকরণ
বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও
বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট (আপীল বিভাগ)
বিগত শতাব্দীর ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দ্বায়িত্ব পালন করার সময় থেকে এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন প্রকার ব্যতিক্রম ধর্মী উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয়েছিল- কী করে তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনা প্রক্রিয়ায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সাধারন ভোটারদের সম্পৃক্ত করা যায়। ঐ সময়ের জাতীয় নির্বাচনোত্তর বিভিন্ন প্রকার স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণামূলক কাজ কর্ম শুরু করেছিলাম। ছোট করে একটি নির্বাচন গবেষণাগার ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপন করতে পেরেছিলাম। আমার চিন্তাধারার প্রায়োগিক দিকটি বিবেচনা করে ময়মনসিংহ জেলার সদর থানার দাপুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের এর সহায়তা ব্যতীত ভোটারদের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছিল। আমি এই ইউনিয়নের বাসিন্দা। সেহেতু আমার সচিবালয়ের অনেকের মতে আমাকে ভয় করেই এই নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে শেষ করেছিল। সেই ব্যপারটি সঠিক নয় প্রমানের জন্য ঢাকা শহর সংলগ্ন টঙ্গী পৌরসভা নির্বাচনও একই প্রক্রিয়ায় সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
এই দু’টি নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করে আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করেছিলাম যে, তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় ভোটারদের ওপর নির্বাচন পরিচালনার দ্বায়িত্ব অর্পন করলে তা অবশ্যই সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। এ দুটো নির্বাচনের বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করেই আমি ১৯৯৪ সালে তদানিন্তন সরকারপ্রধানের কাছে ভোটার আইডি কার্ড প্রণয়ন ও স্থানীয় ভোটারদের ওপর নির্বাচন পরিচালনার দ্বায়িত্ব অর্পন, ভোটার রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি সম্পর্কে একটি প্রজেক্ট দিয়েছিলাম।
এই সম্পর্কে সরকার প্রধানকে প্রায় ঘন্টা তিনেক ব্রিফিং করেছিলাম, তিনি উৎসাহের সাথে উহা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তৎসম্পর্কিত একটি বাজেটও পেশ করেছিলাম। এরই প্রেক্ষাপটে আমার প্রস্তাব অনুসারে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় পরবর্তীতে প্রশাসন ও রাজনীতিবীদদের দূরদর্শীতার অভাবে নানান বাধার সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত আমি স্বেচ্ছায় নির্বাচন কমিশন ছেড়ে কোর্টে চলে আসি।
আমি এখনও দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি যে, স্থানীয় ভোটারদের কাছে নির্বাচন পরিচালনার দ্বায়িত্ব অর্পন করলে অবশ্যই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে দল পরিচালনায় গণতান্ত্রিক কর্মকান্ড অনুসরণে বাধ্যবাধকতায় আনতে হবে। তাদের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে, মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারা বহাল রাখা সম্ভব হবেনা। নির্বাচনে যতদিন পর্যন্ত মনোনয়ন বানিজ্য বজায় থাকবে ততদিন এদেশে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বা হতে পারেনা।
তৃণমূল পর্যায়ে ভোটাররা দলকে ভোট দেবে, তাদের মনোনীত প্রার্থীকে নয়। প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে তারা সংসদের জন্য তাদের মনোনীত ব্যক্তিকে পাঠানের ব্যবস্থা করবেন। আনুপাতিক হারে ভোট প্রক্রিয়ায় এবং এদেশের অতীত অভিজ্ঞতায় সাধারণভাবে একটি প্রশ্ন অবশ্যই জাগে, এলাকাভিত্তিক কোন সংসদ সদস্য মনোনীত হওয়া বা নির্বাচিত হবার কোন সুযোগ থাকবে কি না? এই প্রক্রিয়ায় যেহেতু সংসদ নির্বাচনের কোন এলাকা থাকবেনা, সারা বাংলাদেশ জুড়েই একটি নির্বাচনী এলাকা। কাজেই সংসদে দলের পক্ষে যারা সদস্য হবেন তাদের কোন এলাকা ভিত্তি থাকবেনা। তবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐরূপ সদস্যকে কোন এলাকা ভিত্তিক কার্যক্রমের জন্যে দ্বায়িত্ব দিতে পারবেন। এটা তাদের নিজস্ব ব্যপার।
উল্লেখ্য, ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠানের কমপক্ষে নব্বই দিন পূর্বে, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহ নিজেদের প্রাথমিক সদস্যদের ভোটে মেধাক্রম অনুসারে একটি সদস্য তালিকা তৈরী করে নির্বাচন কমিশনে অবশ্যই দাখিল করবেন। নির্বাচন কমিশন ঐ নব্বই দিনের মধ্যেই তাদের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা, চারিত্রিক নিস্কলুষতা, সামাজিক গ্রহণ যোগ্যতা ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পূর্ন করে এ তালিকা সংরক্ষন করবেন। নির্বাচনে ঐ দল যে কয়টি আসন পাওয়ার অধিকারী হইবে, ঐ তালিকা থেকে ক্রমানুযায়ী দলের পক্ষে সংসদে উপস্থিত থেকে সদস্য হিসেবে কাজ করবেন। অবশ্য প্রয়োজনবোধে দলীয় স্বার্থে বছরে ঐ সদস্যদের শতকরা ৫ ভাগ পরিবর্তনও করতে পারবেন।
আনুপাতিক হারে ভোটপ্রক্রিয়া পরিচালনা ও তার ফলাফলের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ গড়নে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। সেহেতু বিষয়টিকে সর্বসাধারণের বোধগম্য করার উদ্দেশ্যে নিন্মোক্ত উদাহরণ উপস্থাপন করছি-
ধরে নেয়া যাক, নির্বাচনে ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে ৯ কোটি ভোটার ভোট দিয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ পার্লামেন্টে ৩০০ টি আসনের ব্যবস্থা রয়েছে সেহেতু ৩০০ দিয়ে ৯ কোটিকে ভাগ দিলে (৯,০০,০০,০০০ ভাগ ৩০০ = ৩,০০,০০০) প্রতি সংসদ সদস্যদের জন্য ৩ লক্ষ ভোটের প্রয়োজন। ধরে নেয়া যাক, পনেরটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে যারা প্রাথমিক ভোট গণনায় যা ভোট পাবেন প্রতি তিন লক্ষ ভোটের জন্য একজন করে সদস্য সংসদে পাঠানোর অধিকারী হবেন।
অনুর্ধ ৫০০ ভোটারের জন্য একটি করে স্থায়ী ভোটকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সেটা অবশ্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষা ও সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয় ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে দেখভাল করবে। ওটাই হবে গণতন্ত্রের বিকাশ কেন্দ্র। গণতন্ত্র চর্চা-সংক্রান্ত বিষয়াদির উপর একটি গ্রন্থাগারও থাকবে। স্থানীয় শিক্ষিতসমাজ ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের উপর গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা ও প্রয়োজনে পাঠ দানের নির্দেশনা থাকবে।
স্থানীয় বিষয়াদি যথা: দেন-দরবার, শালিস, খেলাধুলা, সাংস্কৃতি চর্চা, ধর্মীয় কার্যাদী সবকিছু সেখানেই চলবে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এমনকি একটি ন্যায্যমূল্যের দোকানও এখান থেকে পরিচালিত হতে পারে। স্থানীয় ভোটাররাই ঔ দোকানের অংশীদার হবে। একই সাথে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ৩ শূন্য (শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য দরিদ্রতা) প্রতিপাদ্যটিও কার্যকরী করার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতি পাড়ায়-মহল্লায় একটি করে ভোটার ক্লাব থাকবে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে ঐ অঞ্চলের সব ভোটাররাই তার সদস্য। তবে ১১ সদস্য (৬ জন পুরুষ ও ৫জন মহিলা) বিশিষ্ট ঐ ক্লাবে নির্বাহী কমিটিতে যারা কোন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য নন তারা থাকবেন। ঐ নির্বাহী কমিটির সদস্যরাই এক উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট পরিচালনার দ্বায়িত্ব নিবে এবং তারাই অংশীদ্বারিত্বের ভিত্তিতে ঐ ভোটকেন্দ্রের যৎসামান্য ব্যয় যোগানের ব্যবস্থা করবে। স্থানীয় শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করবে। শিক্ষিত বয়স্ক ভোটাররা মুরুবি¦ হিসেবে কাজ করবেন। সকাল ৮ টা থেকে ১২ টার ভেতর ভোটগ্রহন শেষ করতে হবে। বেলা ২টার মধ্যে অনলাইনে নির্বাচনের ফলাফল নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা থাকবে। ভোট না দেয়ার জন্য জরিমানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে প্রতি ইউনিয়নে, পৌরসভা ও পৌর কর্পোরেশনের ওয়ার্ডে একজন সহকারি নির্বাচনী কর্মকর্তা ও তার অফিস থাকবে।
আমার সময় আমি প্রতি উপজেলাতে উপজেলা নির্বাচন অফিসার ও অফিসের ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছিলাম । জেলা পর্যায়ে তো জেলা নির্বাচন অফিসার পূর্ব থেকেই রয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়েও ডেপুটি নির্বাচন কমিশনারের অফিস রয়েছে। কাজেই মূলত তৃণমূল পর্যায় থেকে নির্বাচন কমিশন পযন্ত তৃতীয় কোন সংস্থা বা ব্যক্তির কোন প্রভাব থাকবে না বা রাখা যাবেনা।
রাজনৈতিক দল নিবন্ধকরণ ও তাদের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করা
আনুপাতিক হারের নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলের নিবন্ধকরণ অত্যন্ত জরুরী। বর্তমানে চলিত রাজনৈতিক দলগুলোর পুনঃ নিবন্ধন করাতে হবে। প্রত্যেক দলের জন্য মোট ভোটারের অন্ততপক্ষে শতকরা একভাগ রেজিস্টার ভোটারদের প্রাথমিক সদস্যপদ থাকতে হবে এবং তা কমপক্ষে বা সর্বনিন্ম ১০টি প্রশাসনিক জেলায় তাদের সদস্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে হবে।
এদেশের রাজনৈতিক দল সংগঠন ও পরিচালনায় সংগতকারণেই অর্থসঙ্কট রয়েছে। সেই জন্যই নেতানেত্রীরা যে কোন মূল্যে অর্থ সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পরে। এতে করে তাদের আসল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে পারেনা। সেই সুযোগে কুচিন্তা গ্রস্থ ব্যক্তিরা সুযোগ বুঝে অর্থ দেয়ার বিনিময়েও দলে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে নেয়। শেষ পর্যন্ত ওই রাজনৈতিক দলের পবিত্র রাজনৈতিক চরিত্র বিনষ্ঠ হয়। অনেকটাই পাওয়ার মঙ্গার মুখি হয়ে যায়। বেশীর ভাগ রাজনৈতিক দলেরই একই অবস্থা। ভবিষ্যতে যেন কোন রাজনৈতিক দলের অর্থ সংগ্রহ করতে এমন প্রক্রিয়ায় পরতে নাহয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। আনুপাতিক হারের প্রথম নির্বাচনে যে সমস্ত রাজনৈতিক দল মোট প্রদেয় ভোটের ২.৫% ভোট পাবেন তাদেরকেই পরবর্তীতে অন্যান্য আইনের দৃষ্টিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে মনোনীত করা যাবে।
তাদেরকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাষ্ট্রের রেভিনিও বাজেট থেকে অর্থায়ন করা হবে। যাতে করে রাজনৈতিক দল হিসেবে পুতঃপবিত্র চরিত্রের অধিকারী হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারে। অবশ্য তাদের প্রাথমিক সদস্যের সংখ্যানুযায়ী আনুপাতিক হারে অর্থায়নের ব্যবস্থা রাখা যাবে। আনুপাতিক হারে নির্বাচন করতে গেলে সারা বাংলাদেশকে ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করার প্রয়োজন থাকবেনা। সারা বাংলাদেশ একটি নির্বাচনী এলাকা হিসেবে চলে আসবে, তৎসংক্রান্ত মামলা-মোকাদ্দমা, অনুযোগ- অভিযোগের কোন সুযোগ থাকবেনা।
ভোট গ্রহণের দিন সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচনী কর্মকর্তার অনুমতিত্রমে বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তে, যেকোন ভোটার, যেকোন কেন্দ্রে ভোট প্রদান করতে পারবে। সকল প্রবাসী ভোটাররাও অনায়াসে ঐ সমস্ত দেশের বাংলাদেশী দূতাবাসে অতি সহজেই ভোট প্রদান করতে পারবে। উল্লেখিত পরিবর্তনকে নির্বাচন সরলীকরণ প্রক্রিয়া বলা চলে।
বর্তমানে বাংলাদেশ সংবিধান-সংশ্লিষ্ট ও বিভিন্ন নির্বাচনী আইনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ৬ ধরনের নির্বাচন পরিচালনা করে আসছেনঃ
১. ইউনিয়ন পরিষদ; ২. পৌরসভা; ৩. পৌর কর্পোরেশন; ৪. উপজেলা পরিষদ; ৫. জেলা পরিষদ; ৬. সংসদ নির্বাচন। আনুপাতিক হারের একটি নির্বাচন দিয়েই সকল নির্বাচনের প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়া সম্ভব। এতে করে অর্থ ও সময়, শক্তি বাঁচিয়ে অন্য উন্নয়নের খাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া বর্তমানে প্রচলিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকেও সংসদ সদস্যদের দ্বারা সার্বজনীন ভাবে উন্নীত করা যেতে পারে। তাতে করে কোন রাজনৈতিক দলই তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে না হয়। অর্থাৎ নির্বাচনকে একটি সর্বজনীন রূপ দেয়া যেতে পারে।
বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচন পরিচালনা করতে নির্বাচন কমিশনকে বিশেষ বেগ পেতে হয় যেমন- নমিনেশন প্রথার জন্য বিভিন্ন সমস্যা তো আছেই, এই নমিনেশন যাচাই-বাছাই অনেক ক্ষেত্রে আপিল-নিস্পত্তি ইত্যাদির জন্য যতেষ্ট সময় ব্যয় করতে হয়। শেষ পযন্ত ব্যালট পেপার ছাপাতে নির্বাচন কমিশনকে বেকায়দায় পরতে হয়। আর আনুপাতিক হারে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের দুই এক বছর পূর্বেই প্রয়োজনীয় ব্যালট পেপার ছাপিয়ে রাখা যাবে। তাতে করে প্রিন্টিংসহ অন্যান্য খরচাদির সাশ্রয় হবে।
দীর্ঘ দিন যাবত বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, এদেশের মূল সমস্যা হচ্ছে একটি, সেটি হচ্ছে- সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলাবোধের দারুন অভাব। স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকেই ধাপে ধাপে এহেন অবক্ষয় হয়েছে। বর্তমান জনসংখ্যার সিংহ ভাগই ১৯৭১ সালে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিলো। তাদের বয়স যখন ১৮ হয়েছিল তখন থেকেই স্বাভাবিক কারণেই মনে করতে শুরু করেছিল বিশৃঙ্খলাটাই আসলে শৃঙ্খলা। ঐ জনগোষ্ঠী বর্তমান সময়ে ষাট ঊর্ধ্বে পৌঁছে গেছে। তারাই মূলত সর্বস্তরে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভেতর থেকে বিভিন্ন স্তরে এমনকি বিশ^বিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করছে, ব্যবসা-বানিজ্য, শিল্প তথা অর্থনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বিশৃঙ্খলতাই অন্তর্নিহিতভাবে লালিত পালিত হয়ে এখন সর্বস্তরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ঐ জনগোষ্ঠীর কাছে শৃঙ্খলাবোধের অবক্ষয় কোনোভাবেই ধরা পরছেনা। আরো সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, জাতির বিবেক প্রায় বিলুপ্তির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এটাকে এইপর্যায় থেকে মুক্ত করে পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রাত্যহিক ব্যবহারিক জীবনে সুকৌশলে তা চালিয়ে যেতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ভোটাধিকার প্রয়োগ, সংরক্ষন ও ফলাফল অনলাইনের মাধ্যমে অতি দ্রুততার সাথে নির্বাচন কমিশনে পৌঁছে দেয়া ইত্যাদি অবশ্যই সম্ভব হবে।
এতে করে তৃণমূল পর্যায়ের ভোটার নির্বাচন ব্যবস্থায় সর্ব্বোচ সংস্থা নির্বাচন কমিশন ও তাদের মধ্যে তৃতীয় কোন ব্যক্তি কোন প্রকার হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকবেনা। এমনকি বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রেও বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটে যোগফলের হেরফের করার কোন সুযোগ থাকবেনা। অর্থাৎ শতকরা ১০০ ভাগ নিরস্কুশ স্বচ্ছতার মাঝে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া, প্রাপ্ত ভোটের ফলাফল অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে প্রকাশ পেতে থাকবে। এতে করে সাধারন ভোটারদের মাঝে বিলুপ্ত প্রায় ব্যক্তিসত্তা ও আন্ত বিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত রূপে গড়ে উঠতে থাকবে। একই সাথে যদি প্রতিটি ভোটকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে দেয়া যায় তাহলে ঐ ক্ষুদ্র এলাকায় শিক্ষা-দীক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক, অর্থনৈতিক লেনদেন সয়ংক্রিয়ভাবে পুনরুজ্জীবিত হতে থাকবে। তাতে করে সকলের মনের অলক্ষ্যে এমন একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশ ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকবে, যা এখন মানুষ কল্পনাও করতে পারছে না।
উল্লেখিত বিশেষ পরিবেশ পরিস্থিতিসহ বিদ্যমান যাবতীয় পরিবেশ পরিস্থিতির মাঝে সুকৌশলে একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার উন্মেষ ঘটানো আমাদের অত্যন্ত জরুরী। সেই সাথে আমাদের জন্য সর্বস্তরের চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটানোও অত্যন্ত জরুরী। আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি , আনুপাতিক হারের নির্বাচন প্রবর্তনের ফলে সবার মাঝে সুশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির আন্ত বিশ্বাস অবশ্যই গড়ে উঠবে। অন্যথায়, পুনঃ পুনঃ স্বৈরশাসকদের আগমন ঘটতেই থাকবে।
গত কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মীদের কথাবার্তায় আচার-আচরনে এটা স্পষ্ট যে, তারা অতি দ্রুত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে অস্থির হয়ে উঠেছে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, বিগত কয়েক যুগ ধরেই রাজনৈতিক কর্মীরা দল বা নেতা-নেত্রীদের কেন্দ্র করে ব্যক্তি বা সংস্থার নিকট থেকে সময়ে-অসময়ে চাঁদা তুলতে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। এটি অনেকটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে, এমনকি এটিকে মূখ্য কর্মকান্ড হিসেবেও গণ্য করছে। এটিই রাজনৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ। এই চাঁদা তোলার সংস্কৃতি অবশ্যই বন্ধ করাতে হবে। এটি শুনে অবাক লাগে যে, একজন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি তার এলাকা সম্পর্কে এমন ধারনা পোষণ করে চলেছে যে, তার এলাকায় এমনকি কোন পান-বিড়ির দোকান দিলেও ঐ দোকান থেকে পয়সা দিয়ে তাকে পান-বিড়ি কিনে খেতে হবে এটা হতে পারে না। তার রাজনৈতিক অবস্থানে তাকে বিনা পয়সায় পান-বিড়ি খাইয়েই তাকে সেখানে দোকানদারি করতে হবে। কি অদ্ভূত মনোবৃত্তি জেগে উঠেছে! যতদিন এমন প্রকার মনেবৃত্তি থাকবে ততদিন পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়।
তা ছাড়া এটিও দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তাদের লালিত-পালিত সন্ত্রাসীদের বলে দেয় “ চরে খাও আমরা দেখেও না দেখার ভান করব তবে প্রয়োজনে ডাক দিলে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে অবশ্যই হাজির হতে হবে। অন্যথায় ধরে ধরে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয়া হবে।” এহেন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীবৃন্দ ও তাদের নিজ নিজ দলে গনতন্ত্র চর্চার কার্যক্রম শুরু করার জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া ব্যবহার করতে হবে। সেটি হচ্ছে ঃ
রাজনৈতিক দল নিবন্ধকরণ আইনটি পরিবর্তন করে তদস্থলে নতুন পরিস্থিতি চিন্তা রেখে একটি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। যথা-
১। নতুন-পুরনো সব দলকেই রেজিস্টার ভোটারদেরকে তাদের দলের প্রাথমিক সদস্যভূক্ত করতে হবে।
২। যেহেতু আনুপাতিক হারের নির্বাচনে ভোটাররা দলকে ভোট দেবে দলীয় প্রার্থীকে নয়, সেহেতু প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই অন্যূন দেশের সর্বমোট ভোটারদের শতকরা এক ভাগ ভোটারকে তাদের প্রাথমিক সদস্য তালিকায় আনতে হবে। ঐ সংখ্যক ভোটার সংখ্যা অন্যূন ১০টি প্রাশাসনিক জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে।
৩। কোন রেজিস্টার ভোটার একাধিক রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্য থাকতে পারবেনা। যদি কেউ ইচ্চাকৃত ভাবে ঐরূপ সদস্য হয়ে যায় তাহলে তাকে অন্যূন ১০,০০০/- টাকা জরিমানা দিতে হবে ও তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল বলে গন্য হবে।
৪। রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তারা প্রাথমিক সদস্যদের তালিকার ডাটাবেজ তৈরী করে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সারা বছরব্যাপী তা যাচাই-বাছাই করবে। নির্বাচন কমিশন দলগুলোর ঐ প্রাথমিক সদস্যদের যাচাই-বাচাই করে সংখ্যার ভিত্তিতে জাতীয় ফান্ড থেকে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় খরচ যোগান দিবে। অবশ্য প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর পূর্বের কর্মকান্ড যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী অর্থ ছাড় দিতে পারবে। ব্যপারটি আরো পরিষ্কার করে বলা চলে- ধরে নেয়া যাক সারা দেশে ভোটার সংখ্যা এ বছরে ১২ কোটি রয়েছে, ঐ ভোটারের শতকরা একভাগ অর্থাৎ অন্যূন ১২ লক্ষ রেজিস্টার ভোটার অবশ্যই ঐ দলের প্রাথমিক সদস্য হতে হবে। প্রতি রেজিস্টার সদস্যর জন্যে প্রতি বছর ২০ টাকা ব্যয়ভার হিসাব করলে ঐ দলটি সারা বছরে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালানোর জন্য সরকারি বাজেট থেকে দুই মাসিক কিস্তিতে মোট ২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা অনুদান হিসেবে পেতে পারে। তবে বাজেটে অর্থায়নের কমবেশি হতে পারে। যাক তাতে করে অবশ্যই রাজনৈতিক দলের চাঁদা তোলার সংস্কৃতি বন্ধ হতে বাধ্য। এতে করে রাজনীতি কর্মকান্ডে অবশ্যই একটি সুষ্ঠ পরিবেশ গড়ে উঠবে এবং সেই পরিবেশ সত্যিকার অর্থে রাজনীতিবীদ গড়ে তোলার সপক্ষে দৃঢ়তার সাথে সাবলীলভাবে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরীতে সহযোগীতা করতে পারবে।
৫। কোন প্রাথমিক সদস্য দল পরিবর্তন করলে তা অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে।
৬। সরকারি-বেসরকারি কর্মচারিরাও দেশের নাগরিক হিসেবে যেকোন রাজনৈতিক দলে তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক সদস্য থাকতে পারবে। কারণ এটা তাদের নাগরিক অধিকার, কোন অবস্থাতেই এটা খর্ব করা যাবেনা। তবে চাকুরিরত অবস্থায় দলের কোন পদে থাকতে পারবে না।
৭। কোন রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে নিজ দলকে আর্থিক অনুদান দিতে পারবেন এবং ঐরূপ অনুদান অর্থের টেক্স রিবেটও পাবেন।